অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়: কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, এ জীবনে সব সময় তার মীমাংসা হয় না। সত্যিই কোনটা ‘সত্যি’, কেউ কি তার রায় দিতে পারে? আদালত কি পারে তার মীমাংসা করে দিতে?
হ্যাঁ, ‘অনাহূত’ নাটকে একটা আদালতও আছে। তাদের রায়ও আছে। কিন্তু ‘সত্য’ সেই রায়কে ছাপিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
‘অনাহূত’ নাটকে সত্যিই এক আগন্তুক এসে হাজির হয়, আর, ক্রমশ একটা ঝড় ওঠে, তছনছ হতে থাকে সাজিয়ে তোলা কিংবা সাজিয়ে রাখা এক সুখী সংসার। সেই সংসার নিরুপম (সুস্নাত ভট্টাচার্য) আর সুজাতার (অমৃতা মুখোপাধ্যায়)। সেই সংসারে হঠাৎ যে আগন্তুক (সঞ্জীব সরকার) এসে হাজির হয়, সে যে অনাহূত, সেটা তো শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে যায়!
সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর নিরুপম গোস্বামী এখন ব্যবসায়ী। স্ত্রী সুজাতা আর পুত্র দেবোপমকে নিয়ে তার ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। সেই বাড়িতে এক দুপুরে ক্রাচে ভর দিয়ে এসে হাজির এক অনাহূত মানুষ, যে দাবি করে সেই নাকি আসল নিরুপম; যে কিনা কার্গিলে মেজর হিসেবে যুদ্ধ করেছিল এবং এই সুজাতা আসলে তারই স্ত্রী। লোকটা কতটা মিথ্যাচারী, কতটা ভিলেন, কতটা ঠগ, কতটা ব্ল্যাকমেলার, একটার পর একটা প্রশ্ন উঠতে থাকে। নিরুপমের বাড়িতে ওই অনাহূত মানুষটা এসে হাজির হয় সন্ত্রাসের মতো। সে দাবি করে, এই সংসারের কর্তা নিরুপম আসলে মৈনাক। অদ্ভুত সব দাবি এবং একের পর এক প্রমাণপত্র পেশ করতে থাকে ওই আগন্তুক। নিরুপম–সুজাতার সংসার লন্ডভন্ড করার এই চেষ্টা বন্ধ করতে তারা পুলিশ ডাকে। বিষয়টি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আদালত কি পারে ‘সত্যি’ নির্ধারণ করতে? সেখানে তো ‘মিথ্যে’ জেনেও কোনও না কোনও পক্ষের উকিল তো মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করার যুক্তি সাজায়, তথ্য–প্রমাণ পেশ করে। এই অংশটাও ‘অনাহূত’ নাটকে অন্য মাত্রা যোগ করে।
শেষ পর্যন্ত ‘সত্যি’ কি প্রতিষ্ঠিত হয়? স্নেহাশিস ভট্টাচার্যর এই নাটক সংসার ও জীবনের সত্যি–মিথ্যার এক জটিল খেলাকে বেশ দক্ষতার সঙ্গে ধরেছে। কোথাও এক ঝলক ‘উত্তরায়ণ’ সিনেমার কথা মনে এলেও, এ নাটকের মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে ওই কাহিনির বা সিনেমার মিল নেই। আর, সীমা মুখোপাধ্যায়ের দক্ষ নির্দেশনায় এই নাটক কখনও সুখী গার্হস্থ্য, কখনও ভিলেনি, কখনও থ্রিলারের আবহ তৈরি করে, জীবনের সত্যি–মিথ্যার একটা টান–টান নাটক তৈরি করে। কাহিনির যদি কিছুটা অবাস্তবতা থাকে, সেটা সীমা মুখোপাধ্যায়ের নিপুণ পরিচালনা এবং কুশীলবদের দুর্দান্ত অভিনয়ে ঢাকা পড়ে যায়। সন্দীপ সুমন ভট্টাচার্যের মঞ্চ, বাদল দাসের আলো, দিশারি চক্রবর্তীর আবহ এ নাটকের সামগ্রিক সম্পদ।
‘অনাহূত’ প্রমাণ করল, যে দলের প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রয়াত দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, সেই ‘সংস্তব’ তাদের থিয়েটারের জোরেই এগিয়ে চলবে, বাঁচিয়ে রাখবে তাঁর স্বপ্নকে। এই সময়ের অন্যতম সেরা পরিচালক সীমা মুখোপাধ্যায়ও দ্বিজেনবাবুর স্বপ্নকে এগিয়ে দিলেন।
অভিনয় এই নাটকের বড় সম্পদ। অনাহূত লোকটির চরিত্রে সঞ্জীব সরকার অনবদ্য। সঞ্জীবের অভিনয়ের একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। সেই ধাঁচটাকে দুর্দান্ত ব্যবহার করে আগন্তুক লোকটিকে দর্শকদের কাছে কখনও সত্য, কখনও মিথ্যের দোলাচলে রেখেছেন সঞ্জীব, তাঁর অসাধারণ অভিনয়ে। নিরুপমের ভূমিকায় সুস্নাত ভট্টাচার্যও প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কাজের লোক যুধিষ্ঠির আর কাজের মেয়ে মেনকার একটা দারুণ উপভোগ্য জুটি তৈরি করেছেন পার্থসারথি চন্দ্র এবং কঙ্কাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে উল্লেখ থাকুক, কঙ্কাবতী হলেন দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা। এ–ও এক ভরসা সংস্তবের দর্শকদের জন্যে। দুই উকিলের ভূমিকায় আশিস মজুমদার, পার্থসারথি সেনগুপ্ত, পুলিশ অফিসার শ্রীকান্ত মান্নাও এ নাটকের গতি বজায় রেখেছেন। একটি ছোট চরিত্রে যথাযথ সঞ্জয় দাস।
এবং সুজাতার ভূমিকায় অমৃতা মুখোপাধ্যায় এ নাটকে প্রমাণ করলেন তাঁর অভিনয় দক্ষতা এবং আশ্বাস দিলেন, আগামী দিনগুলোকে বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে তিনি আরও বিকশিত হবেন। সত্যি কথা বলতে কী, এই নাটকে সঞ্জীব সরকারের দাপুটে অভিনয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সেটা যথার্থভাবে পেরেছেন সুজাতার চরিত্রে অমৃতা মুখোপাধ্যায়।
আর এ নাটকের সত্যি–মিথ্যের খেলাটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছে তো সুজাতাই। তার সামনেই তো দুই পুরুষ, একই অধিকার আর দাবি নিয়ে। সেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি জানে, সত্যির ভিতরে একটা ‘সত্যি’ আছে/ মেঘের ভেতরে আছে জল/কোনও কোনও হাসির আড়ালে/অশ্রু ছলোছল।
‘অনাহূত’ সেই ‘সত্যি’ আর হাসির আড়ালে থাকা ‘অশ্রু’–র কাছেই বোধহয় পৌঁছোতে চেয়েছে।