সম্রাট মুখোপাধ্যায়: ● ভাল লোক। নাটক: চন্দন সেন (লুইজি পিরানদেল্লো অনুপ্রাণিত)। পরিচালনা: মেঘনাদ ভট্টাচার্য। প্রযোজনা: সায়ক
পিরানদেল্লোর জীবনকে বাদ দিয়ে তাঁর শিল্পকে বিচার করা সম্ভব নয়। তাঁর নাটক নিয়ে যাঁরা কাজ করেন আর তাঁর জীবনকে যাঁরা জানেন, তঁারা মানেন এ কথার তাৎপর্য।
আর তাই হয়ত পিরানদেল্লোর নাটকে বারবার এসে পড়ে অসুখী পারিবারিক সম্পর্কের ছায়াপাত। অবৈধ সম্পর্ক, বাবা ও সন্তানের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি, বিচ্ছেদ, রাজনীতির অশুভ চাপ ব্যক্তিজীবনে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো বারবারই ঘুরে ঘুরে এসেছে তাঁর নাটকে।
১৯২০ সালে তাঁর লেখা ‘অল ফর দ্য বেস্ট’ নাটকটি বেরোয়। মনে রাখতে হবে, তখনও তাঁর জগৎবিখ্যাত নাটক ‘সিক্স ক্যারেকটার্স ইন দ্য সার্চ অফ এন অথর’ (‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’ নামে প্রযোজনা করেছিল নান্দীকার) লেখা হয়নি। তা লেখা হবে আরও এক বছর পরে ১৯২১–এ। আর এ নাটক লেখার আগে ১৯০৬ সালে একই কাহিনী নিয়ে পিরানদেল্লো লিখেছিলেন উপন্যাস ‘টুট্টো পার বেন’ এই নামে।
এসব কথাগুলো শুরুতেই বলে নেওয়ার কারণ এ নাটক ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’র মতো জটিল নয়। আর সম্পর্কের নাটক হয়েও, আদ্যন্ত চেম্বার ড্রামা হয়েও এ নাটকে আছে এক উপন্যাসের মতো বিশালধর্মীতা।
এই ব্যাপারটাকে ভারী সুন্দর নিজের অ্যাডাপ্টেশন–এ এনেছেন চন্দন সেন। এর আগেই সদ্য তিনি লিখেছেন পিরানদেল্লোর জীবন নিয়ে একটি নাটক। অদ্ভূত মসৃণতায় এ নাটককে বঙ্গ জীবনে এনেছেন চন্দনবাবু। একবারও মনে হয় না এ নাটক বিদেশি। মনে হয় না ২০০ বছরের পুরনো।
নাটকের কেন্দ্রবিন্দু মাঝের চর। সেখানে ঈশ্বর প্রতীম সম্মানে বিরাজমান এক ভাল মানুষ সত্যচরণ (মেঘনাদ ভট্টাচার্য)। তাঁকে ঘিরে থাকে বন্ধু জলেশ্বর আর দীর্খদিনের গৃহকর্মী প্রভা। সত্যচরণের বিপরীতেই আছে বন্ধু রাজনীতিবিদ ধূর্জটিনারায়ণ (আশিস ঘোষ)। ভাবনা এবং কর্মে সে যেন অভিনেতার শারীরিক সাযূজ্য যে ভাবনাটাকে আরও স্পষ্ট করে। আর এই দুজনের মধ্যে ইডিওলজির যে লড়াই তা পিরানদেল্লোর নাটকের নিয়ম মেনে হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তি সম্পর্কের লড়াইও। এক ত্রিকোণ সম্পর্ক। না, প্রেম নিয়ে নয়। পিতৃত্ব নিয়ে। স্ত্রী–হারা সত্যচরণকে সাহায্য করতে তার মেয়ে কল্পাকে (কথাকলি) নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে কন্যা স্নেহে মানুষ করে ধূর্জটি। একসময় কল্পাকে সে জানায় সেই কল্পার অবৈধ কিন্তু আসল বাবা। কল্পাও মুগ্ধ হয়ে পড়ে ধূর্জটির বৈভব, ক্ষমতা আর বাকপটূতায়। ভুলে যেতে থাকে সত্যচরণকে।
এ যেন এক অন্য ঘরে বাইরে। যেখানে এক মধ্যবর্তিনী নারী বাকপটূ এক রাজনীতিবিদের কথায় উপেক্ষা করতে থাকে তার জীবনের প্রধান পুরুষকে। মূলত অভিনয় প্রধান এ নাটককে চমৎকারভাবে মঞ্চস্থ করতে পরিচালক মেঘনাদ ভট্টাচার্যকে সবচেয়ে সহায়তা করেছেন অভিনেতা মেঘনাদ ভট্টাচার্য। তা ছাড়া এমন একটি লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র মঞ্চে আনা দুঃসাধ্য হত। আশিসবাবুও দ্বৈরথ চালিয়েছেন ভালই। আর কল্পা হিসেবে কথাকলি তো অনবদ্য। প্রভার চরিত্রে রুণা মুখোপাধ্যায় এ নাটকের সম্পদ।
পিরানদেল্লোকে মাঝখানে রেখে চন্দন–মেঘনাদ বাংলা নাটকের প্রবাদ জুটি আরেকবার সফল করমর্দন সারল। সেই দায়বদ্ধ, সেই বাবা–মেয়ের জটিল ও সফল গল্পের কথা আরেকবার মনে করাল। এ যেন তাঁদের শিকড়ে ফেরা।