সম্রাট মুখোপাধ্যায়: রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন, তখন ১৯ বছর হয়েছে। বাঙালির ঘরে ঘরে তখন রবীন্দ্র কাব্যের অনুরণন। গীতিনাট্য–নৃত্যনাট্যগুলো গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে বেরোচ্ছে জনপ্রিয়তার নতুন জোয়ার তুলে। মঞ্চে ‘বহুরূপী’ রবীন্দ্র নাটককে দিয়েছে উচ্চতার অন্য মাত্রা। জন্ম হয়েছে নবনাট্যের।
শুধু পর্দায় সেভাবে জোয়ার ডাকেনি রবীন্দ্রনাথে। তঁার মৃত্যু ১৯৪১–এর আগস্টে। তারপর ১৯৫৯ পর্যন্ত দু’দশকে তঁার কাহিনি অবলম্বনে ছবি মাত্র ১২টি। তার মধ্যে আবার হিট মাত্র তিনটি। নরেশ মিত্রর ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ (১৯৫৩), দেবকীকুমার বসুর ‘চিরকুমার সভা’ (১৯৫৬), তপন সিংহর ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭)। পর্দায় এসেও বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়েছে চারটি রবীন্দ্র উপন্যাস। ‘নৌকাডুবি’ (পরি: নীতিন বসু), ‘মালঞ্চ’ (পরি: প্রফুল্ল রায়), ‘শেষের কবিতা’ (পরি: মধু বসু), ‘যোগাযোগ’ (পরি: নীতিন বসু)। এই সময়ের ভেতর বোঝা যাচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথ অবলম্বনে সিনেমাকে ‘বই’ বলে নিতে রাজি নয় বাঙালি। তঁাকে যেন বইয়ের পাতায় পড়তেই স্বচ্ছন্দ তারা।
১৯৬০
পরিস্থিতিটা বদলাল ১৯৬০–এ এসে। সেই বছর, যে বছর ২৫শে বৈশাখ থেকে শুরু হল রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর উদ্যাপন। যা চলবে পরের বছরের ২৫ বৈশাখ পর্যন্ত। আর এই ’৬০/’৬১–তেই বদলাল পরিস্থিতিটা।
১৯৬০–এর বৈশাখে পরপর দু’সপ্তাহে মুক্তি পেল রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প–নির্ভর দুটি ছবি। অগ্রদূতের ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ মুক্তি পেল ২৮ এপ্রিল উত্তরা–পূরবী–উজ্জ্বলার চেইনে। আর তপন সিংহর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ৬ মে মিনার–বিজলি–ছবিঘরের চেইনে। এবং দুটিই বক্স অফিস সাফল্য পেল। খরা কাটল আরও একবার।
মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু সেই সময়, যখন উত্তম আর সৌমিত্রকে ঘিরে বাঙালি দর্শক দু’ভাগে ভাগ হতে শুরু করেছে সবে। ফলে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে এ ছিল উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মুখোমুখি হওয়া। সুখের কথা, ম্যাচ ড্র হল। দুজনের ছবিই বক্স অফিসে জিতল। সত্যজিৎ ক্যাম্পের বাইরে প্রথম পা রাখলেন সৌমিত্র। এখানে একটা তথ্য খুব জরুরি হয়তো। এর আগে সৌমিত্র কোনও সরাসরি রবীন্দ্র–কাহিনি ভিত্তিক ছবিতে অভিনয় করেননি। উত্তম কিন্তু করে ফেলেছেন। এর আগেই তিনবার। তার মধ্যে দুটিই সফল— ‘বউ ঠাকুরানীর হাট’ এবং ‘চিরকুমার সভা’।
কিন্তু তারও আগে উত্তম যখন ‘উত্তমকুমার’ হননি, নিছকই অরুণকুমার, তখন এ ছবিতে অফার পেয়েছিলেন অসিতবরণের ছোটবেলাটা করবার। করেওছিলেন। আর সেটাই ছিল হবু মহানায়কের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। নীতিন বসু পরিচালিত সে ছবির নাম ছিল ‘দৃষ্টিদান’। ১৯৪৮–এর বৈশাখ মাসে চিত্রা (রবীন্দ্রনাথের কাব্যের নামে নাম ছিল সে সিনেমা হলের) প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল এ ছবি। এটা নজরের আড়ালে চলে যায় হয়তো, কিন্তু তথ্য হিসেবে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, বাঙালির মহানায়কের যাত্রা শুরু হয়েছিল মহাকবির নানা অনুষঙ্গ ধরেই। পরিচালক নীতিন বসু ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। বিশ্বকবির বানানো একমাত্র সিনেমা ‘নটীর পূজা’র আলোকচিত্রশিল্পী। ফলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে স্বাভাবিকভাবেই চ্যালেঞ্জটা ছিল কঠিন। নিয়েওছিলেন চ্যালেঞ্জটা তিনি শরীরে–মনে। তপনবাবুর কাছ থেকে শিখেছিলেন নায়কোচিত হঁাটার ঢং। ছবিতে ঘোড়ায় চড়তে হবে বলে ভর্তি হতে হয়েছিল রাইডিং স্কুলে। কাজটা কঠিন ছিল পরিচালক তপন সিংহর কাছেও। সেটের গ্রাফ করে করে স্ক্রিপ্ট করেছিলেন। সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎবাবু। তপনবাবু নিজে পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এ ছবি করতে গিয়ে রাতের ঘুম চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল তঁার। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সে বছরের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার পায়। তখন বলা হত ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’।
অন্যদিকে, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ করার জন্য নিজেকে প্রবলভাবে ভাঙছিলেন উত্তমকুমার। ‘অগ্রদূত’–এর বিভূতি লাহা (ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি জনপ্রিয় ছিলেন ‘খোকাদা’ নামে) যখন উত্তমকে জানালেন তিনি ভাবছেন ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ করবেন, শুনেই উত্তম বললেন, ‘রাইচরণ ছাড়া অন্য কোনও চরিত্র দিলে কিন্তু করব না।’ শুটিং চলার সময় চুলে শ্যাম্পু কম করতেন। করলেও চিরুনি ছেঁায়াতেন না। সকাল থেকে যথাসম্ভব কম কথা বলতেন। চোখে পুরু লেন্সের চশমা, মাথায় ঝঁাকড়া না–অঁাচড়ানো চুল, ভাঙা কোমরের ভৃত্য রাইচরণ— এ এক অন্য উত্তমকুমার। বক্স অফিস ভেঙে পড়ল।
মনে রাখতে হবে সালটা ১৯৬০। উত্তম–সুচিত্রা জুটি তুঙ্গে। এই বছরেই সুপ্রিয়ার সঙ্গে জুটিতে সুপারহিট হচ্ছে ‘শুনো বরনারী’। অর্থাৎ উত্তম তখন বাঙালি জীবনে রোমান্সের ক্যালেন্ডার। সেই উত্তম এমন ‘ডি–গ্ল্যামারাইজ’ চরিত্রে! ঝুঁকিটা কম বড় ছিল না। হয়তো রবীন্দ্রনাথ বলেই সম্ভব হল। উত্তমের কেরিয়ারের মতো চরিত্রাভিনয়ের ইনিংসও শুরু হল বিশ্বকবির নাম নিয়েই।
‘ক্ষুধিত পাষাণ’–এর শুটিং যখন চলছে, তখনই চলছিল সত্যজিৎবাবুর ‘দেবী’র শুটিংও। এ ছবিরও নায়ক ছিলেন সৌমিত্র। দুটি ছবিতেই সৌমিত্রবাবু ছাড়া ছিলেন ছবি বিশ্বাস। প্রসঙ্গত, ‘দেবী’–ও প্রকারান্তরে রবীন্দ্র–সিনেমাই। এ’ছবির কাহিনিকার হিসেবে নাম যায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। কিন্তু রবীন্দ্র–গবেষকদের বক্তব্য, এ’গল্পের আখ্যানভাগ প্রভাতবাবু রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকেই পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, এ’ছবিই ১৯৬০–এ বছরের সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার পায়। ‘দেবী’ সফলভাবে চলে হল থেকে উঠে যাওয়ার পরে মিনার–বিজলি–ছবিঘরের চেইনেই ঢোকে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’।
আর একটা ব্যাপারও লক্ষণীয় এই বছরটায়। বাংলা সিনেমার অন্যতম দুই প্রধান পুরুষ হতে চলা ঋত্বিককুমার ঘটক ও মৃণাল সেন এ’বছরটায় সরাসরি রবীন্দ্র–কাহিনিভিত্তিক ছবি না করেও রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়েছিলেন। ঋত্বিক–এর ছবি ছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’। তাঁর একমাত্র বক্স অফিস সফল ছবি। ছবিজুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রবীন্দ্র–কবিতার আশ্চর্য সব প্রয়োগ। নামটিও নেওয়া রবীন্দ্র–গানের একটি কলি একটু ওলট–পালট করে। আর কাহিনির আত্মায় তো সংস্থাপিত নারীর জন্য রবীন্দ্রনাথের চিরকালের সংবেদিত চিত্ত।
মৃণাল সেন বানালেন ‘বাইশে শ্রাবণ’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতারিখে ছবির নাম। মৃণাল সেনের পথ বদলের প্রথম ছবি। তা–ও শুরু হল রবীন্দ্র–অনুষঙ্গ বেয়েই। ১৯৪১–এর কলকাতায় যুবক মৃণাল দেখেছিলেন এক মৃত সন্তানের অসহায় বাবাকে, যিনি নিজের সন্তানের শেষকৃত্য কীভাবে করবেন তা ভাবতে পারছেন না। এদিন শহর যে উত্তাল বিশ্বকবির মৃত্যুর শোকমিছিলে। এই বেদনার স্মৃতিতেই দারিদ্র্য আর মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখেছিলেন মৃণাল এ’ছবিতে। অর্থাৎ মৃণাল ও ঋত্বিক, দু’জনেরই জীবনের দু’টি বাঁকবদলের গুরুত্বপূর্ণ ছবি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই। তাঁর জন্মশতবর্ষের সূচনায়।
যে ১৯৬০–এ সত্যজিৎ–ঋত্বিক–তপন–মৃণাল–ছবি–উত্তম–সৌমিত্র সকলেই ছিলেন রবীন্দ্রমগ্ন।
১৯৬১
পাথরটা যে সরেছে বোঝা গেল ১৯৬১–এর পাঁচটি ছবিতে। চারটি সরাসরি রবীন্দ্রকাহিনি–নির্ভর। অন্যটি নামে।
মৃণাল সেন এ’বছরও আধুনিক গল্প থেকে ছবি করলেন। কিন্তু নাম রাখলেন রবীন্দ্র–কাব্যের নামে। ‘পুনশ্চ’। ছবি হিট হল না। জীবন গাঙ্গুলি রবীন্দ্রনাথের জটিল মনস্তাত্ত্বিক গল্প ‘কঙ্কাল’ অবলম্বনে বানালেন ‘সন্ধ্যারাগ’। নায়ক অসিতবরণ। এ’ছবিও বক্স অফিসে চলেনি।
নতুন রকমের ঘটনা ঘটালেন দেবকীকুমার বসু। রবীন্দ্রনাথের চারটি কবিতার সিনেমা–রূপ তৈরি করলেন তিনি। ‘পূজারিণী’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘অভিসার’, ‘পুরাতন ভৃত্য’। অভিনয় করলেন অনুপকুমার (পুরাতন ভৃত্য), জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় (জমিহারা উপেন), মঞ্জুশ্রী চাকী (নটী), সন্ধ্যা রায়ের (বাসবদত্তা) মতো শিল্পীরা। এ’ছবি প্রযোজনা করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। চারটি ছোট ছবির একসঙ্গে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অর্ঘ্য’। রাজ্যজুড়ে মাঠে মাঠে পর্দা টাঙিয়ে দেখানো হত এ’ছবি। সিনেমা দেখানোর এক বিকল্প পথের সূচনা হল রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়েই। যা পরবর্তীতে ‘১৬ মিলিমিটার মুভমেন্ট’ বলে চিহ্নিত হবে বিকল্প পথের পরিচালকদের কাছে। এ ছবি মুক্তি পেয়েছিল ২৫ বৈশাখেই।
তবে ১৯৬১ সত্যজিৎ রায়ের বছর। দু’টি ছবি বানালেন তিনি। বা হয়তো চারটি। ‘তিনকন্যা’ তো আসলে তিনটি পৃথক ছোট ছবি। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মণিহারা’, ‘সমাপ্তি’। দেবকী বসুর ‘অর্ঘ্য’র কথা ভাবুন। ১৯৬১ হয়ে উঠেছিল বাংলায় ছোট ছবির (আজকের ভাষায় শর্টফিল্ম)। সফল আঁতুড়ঘর। রবীন্দ্রনাথকে উপলক্ষ করেই। তখনও ‘কলকাতা ৭১’–এর মতো ‘বক্স ফিল্ম’ হয়নি। বাংলা ছবির তিন প্রতিভাময় নায়ক–অভিনেতা ছিলেন তিনটি অংশে। অনিল চট্টোপাধ্যায়, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অপর্ণা সেনের পথচলার শুরু। তখন তিনি দাশগুপ্ত। মৃন্ময়ীর বালিকা থেকে নারীত্বে উত্তরণ দেখাতে মাত্র তিনটে শট ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দুই অসামান্য জুটি শর্মিলা ঠাকুর আর অপর্ণা সেনকে পরপর দু’বছর দু’টি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। ‘দেবী’, আর ‘সমাপ্তি’। উত্তম–সুচিত্রা পরিণত জুটির চোখ ধাঁধানো মধ্যগগনে দু’টি স্নিগ্ধ চাঁদের ছায়া এনেছিলেন সত্যজিৎ।
তবে এ’বছরে তাঁর মহত্তম কীর্তি ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রটির নির্মাণ। আজও পর্যন্ত এভাবে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ আর কোনও তথ্যচিত্রে ধরা পড়েননি। ছবিটি তৈরি করেছিল ভারত সরকারের ‘ফিল্মস ডিভিশন’। এ’ছবির সঙ্গীত পরিচালনা সত্যজিৎ রায় করেননি। করেছিলেন বটুকবাবু। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র।
এই তথ্যচিত্রের শুটিং আর ‘সমাপ্তি’র শুটিং চলেছিল একসঙ্গে। ‘সমাপ্তি’র শেষে মৃন্ময়ীকে যেখানে খোঁজা হচ্ছে, তার আউটডোর শুটিং শেষ করে, একই জায়গায় শুটিং করা হয়েছিল ‘হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু গুরু গুরু’, তথ্যচিত্রের এই গান আর তার সঙ্গে পদ্মাবক্ষে বৃষ্টি পড়ে চলার অংশটি। ‘তিনকন্যা’ আর ‘রবীন্দ্রনাথ’ মুক্তিও পায় একই দিনে। ৫ মে, ১৯৬১।
যার তিনদিন পরে ছিল ২৫ বৈশাখের সকাল। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ সমাপ্তির।