রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে তো বটেই, রিয়্যালিটি শো নিয়েও তিনি আক্রমণাত্মক। কারণ, গানটা তাঁর কাছে ব্যবসা নয়। প্রাণের আরাম। মুখোমুখি লোপামুদ্রা ভৌমিক।
অনেকদিন পর রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম করলেন কি কোনও বিশেষ কারণে?
আরতি মুখোপাধ্যায়: রবীন্দ্রনাথের গান আমি বরাবরই গেয়ে আসছি। সেভাবে বলতে গেলে জীবনের শুরু থেকেই আমার স্বত্তা রবীন্দ্রনাথের গানে বাঁধা। বিশেষ কোনও কারণ নেই। রবি ঠাকুরের গান আমার অন্যতম ভাললাগার জায়গা। সবসময়ই গাইতে ইচ্ছে করে। সেই থেকেই অ্যালবাম।
বেশকিছু বছর ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে। সে বিষয়ে আপনার মতামত কী?
আরতি: রবি ঠাকুরের গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা অজ্ঞানতার কথা। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতেই তো আরও কয়েক শতাব্দী লেগে যাবে। রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মনীষী, যিনি সঙ্গীতের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আত্মস্থ করে তবেই সঙ্গীতের রাজ্যে বিচরণ করেছেন। ওঁর মতো একজন মহীরূহকে ধরা মুখের কথা নয়। তাঁকে নিয়ে পরীক্ষা করার যোগ্যতা আমাদের কোথায়? আর পরীক্ষার ফলই বা কী হচ্ছে? কিছুই না। নিতান্ত বোকামি হচ্ছে। আমি রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছি দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। আমার কাছে ওসব উল্টোপাল্টা কাজের কোনও জায়গা নেই। শুনতেও চাই না। রবীন্দ্রনাথের কোনও প্রতিপক্ষ হয় না। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে গেলে ভাষার জ্ঞান থাকতে হবে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দখল রাখতে হবে এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতটাকেও আত্মস্থ করতে হবে। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পরীক্ষা করছেন তাঁদের লেভেলটা ঠিক কোথায়, সেটা আগে জানা দরকার। রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব দর্শন, ভারতীয় ঐতিহ্য, নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং সাহিত্যগুণ মিশিয়ে একটা গান তৈরি করতেন। যিনি ওই গানগুলো গাইবেন, তাঁদেরও ওই দর্শনটাকে ছঁুতে হবে। তাঁকে বুঝতে হবে। তবেই তো গান গাইবার সার্থকতা। আমি আবার বলছি, আমি রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছি দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও অমূলক কাজের জায়গা নেই।
বাংলা গানের স্বর্ণযুগে আপনাকে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পরস্পরের প্রতিপক্ষ মনে করা হত। এই ‘বনাম’ ব্যাপারটা আপনাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলেছিল?
আরতি: সন্ধ্যাদি আমার থেকে অনেকটাই বড়। আমাদের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল ছিল এবং আছে। কোনওদিনই বাইরের কোনও অপপ্রচার আমাদের মধ্যে তিক্ততা নিয়ে আসেনি। আমি তো সন্ধ্যাদির বাড়িও গেলাম কিছুদিন আগে। তাঁকে দেখে এসেছি।
কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, সন্ধ্যাকে দিয়ে বিশেষ কিছু গান গাওয়ানো যায়। আর আরতিকে দিয়ে সব ধরনের গান অবলীলায় করানো যায়। কারণ, আরতি ‘ভার্সেটাইল সিঙ্গার’।
আরতি: হ্যাঁ। বলেছিলেন। মান্নাদাও এই কথাটা সবসময় বলতেন। এমনকী, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষেরও একই বক্তব্য ছিল। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় তো বহু গানে সুর করতেন। উনি সবসময় বলতেন যে, আরতি হলে ভাল হয়। তবে হেমন্তদা বলতেন, আরতির পুজোর যে অ্যালবাম বের হয় তাতে কোনও বছরের সঙ্গে কোনও বছরের যোগ থাকে না। কিন্তু আমার সামনে তাঁরা এসব কথা কখনও বলেননি। আমি ওঁদের থেকে এতটাই ছোট ছিলাম, যে অগাধ স্নেহ পেয়েছি প্রত্যেকের কাছ থেকে। প্রখ্যাত সুরকাররা সে সময় প্রকাশ্যে বলতেন, আরতি ছাড়া এ গান হবে না। আমি কিন্তু কোনওদিন নিজের জন্য কাউকে বলিনি। তাঁদের আমার গানের স্টাইল ভাল লাগত বলেই তাঁরা আমাকে চাইতেন। প্রশংসা করতেন। এটা আমার কাছে বিরাট পাওনা। বাংলা এবং মুম্বই দু’জায়গাতেই।
আপনার মুম্বইজীবন কি বাংলা গানের কেরিয়ারকে কোনওভাবে ধাক্কা দিয়েছে?
আরতি: আমি কোথায় চলে গেছি? আসা–যাওয়া তো প্রতিনিয়তই ছিল। এটা কিছু মানুষের ছড়িয়ে দেওয়া গুজব। তাঁদের মনে হয়েছিল, আরতি তো চলে গেছে। আবার তাকে নিয়ে কেন টানাটানি? তাকে কেন ডাকাডাকি? এরকম অনেকেই তো আছেন। আমি মুম্বইতে গিয়েছি— ওই সুযোগটা তাঁরা কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। রোজই তো আর কলকাতায় রেকর্ডিং হত না। প্রতিদিনই তো আর অনুষ্ঠান থাকত না। তাই আমি পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছি, এটা রটিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়।
কিন্তু মুম্বইতে যতটা খ্যাতি পাওয়ার কথা ছিল ততটা তো পেলেন না? এর পেছনে কি মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির চিরাচরিত রাজনীতি? আরেকটা কথা— এখন রিয়্যালিটি শোয়ের এত রমরমা। আপনাকে বিচারকের আসনে দেখা যায় না কেন?
আরতি: গানের জগতের রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে মাথাই ঘামাইনি কোনওদিন। আমাকে যে গানগুলো গাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে, সেগুলো মন দিয়ে গেয়েছি। শ্রোতাদের ভাল লেগেছে। গানগুলো বিখ্যাত হয়েছে। এর থেকে আর বড় কথা কী আছে? তবে মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে হয়তো আরও কিছুটা জায়গা পেতে পারতাম। যদিও তা পাইনি বলে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আমি প্রচুর মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। সেটাই তো অনেক পাওয়া। আর রিয়্যালিটি শোয়ে আমি যাই না।
যান না কেন? ভাল লাগে না?
আরতি: নাহ্। লাগে না। রিয়্যালিটি শো কী করতে পারছে, সেটা ভবিষ্যতে জনগণ বিচার করবেন। আমার প্রথম ও শেষ পরিচয়— আমি একজন সঙ্গীতশিল্পী। গানটাই আমার জীবনের সবকিছু। সুতরাং কোনও রিয়্যালিটি শো–তে গেলে আমি নিশ্চয়ই গানটাই শুনতে চাইব। জাগলারি চাইব না। এই সব শো–তে যাঁরা গাইছেন, তাঁদের নিজস্বতা খুঁজব আমি। যে গানগুলো বহুশ্রুত, চিরকালীন, সেগুলো তাঁদের কণ্ঠে শুনতে যাব কেন? আমি বিশ্বাস করি, গানটা ব্যবসা নয়। গানটা হল প্রাণের আরাম। মনের শান্তি। গান হল ভগবানের আশীর্বাদ।