দাউদ হায়দার: দিনক্ষণ তারিখ এমনকী সালও মনে পড়ছে না, হতে পারে আশি দশকের গোড়ায়, শান্তিনিকেতনে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘ইতি’ বাড়িতে দু’জন হাজির। একজন শ্যামলী খাস্তগীর। ওঁকে চিনতুম। জিজ্ঞেস করেন, ‘মাসিমার (লীলা রায়) আসার কথা ছিল, কবে আসবেন?’
শ্যামলী পরিচয় করিয়ে দেন সঙ্গিনীকে, ‘ওঁর নাম তৃণা পুরোহিত।’
শান্তিনিকেতনের অনেকেরই জানা, অন্নদাশঙ্কর–লীলা রায়ের কাছে আশ্রিত, থাকি কলকাতায়, কিন্তু অন্নদাশঙ্করের শান্তিনিকেতনে ‘ইতি’ বাড়ির দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছি, মাসে একবার যাই। দিন সাতেক থাকি। লাবুদি (এস্রাজশিল্পী অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা) বলেন, ‘তোমার দাদুদিদু (অন্নদাশঙ্কর–লীলা রায়) কী তোমার নামে বাড়িটি লিখে দিয়েছেন? তুমিই প্রতিমাসে এখানে। দখলদারি।’ প্রায়–একই কথা, একটু ঘুরিয়ে, শিল্পী মুকুল দে’র স্ত্রী বীণা দে’র, এমনকী সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর দুই কন্যারও। প্রবোধচন্দ্র সেন, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও জানতে চান, ‘অন্নদাশঙ্করের বাড়িটি এখন তোমার?’ — ‘না।’ বিস্তারিত বলি। বললেও, ‘অনেকটাই নিজের বাড়ি।’ ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। আসেন অনেকেই, সমরেশ বসু, সন্তোষকুমার ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নীলিমা সেন (বাচ্চুদি), গোরা সর্বাধিকারী, বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী, নানাজন। ‘ইতি’ হয় দুই বাংলার মিলনক্ষেত্র, মিলনবাড়ি।
শ্যামলী একবার জানতে চান, ‘সুধীর খাস্তগীরের নাম শুনেছ?’ বলি, ‘উনি চাঁটগাইয়া’ (চট্টগ্রাম)। এই নিয়ে হাসাহাসি। বলেন ‘আমরা কিন্তু শুঁটকি খাই না।’
শ্যামলীর নিবিড় আত্মীয়, হালের বিশ্বসাহিত্যে বহুমান্য লেখক অমিত চৌধুরী, এক লেখায় খাস্তগীর–পরিবার নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। স্মৃতিচারণে যে–ঘনতা, শান্তিনিকেতন দৃশ্যত। ওই দৃশ্যে তৃণা পুরোহিত নেই, কিন্তু তৃণার উপস্থিতি অলক্ষে। পরিমণ্ডলে। পারিপার্শ্বিকে।
তৃণা পুরোহিতের বৃত্তান্ত বলেননি শ্যামলী। কিছু শুনি অন্নদাশঙ্কর–লীলা রায়ের মুখে। ঘনিষ্ঠ ছিলেন ওঁদের। তৃণার জন্ম কলকাতায় (১/১০/১৯২৭/ মৃত্যু শান্তিনিকেতনে, ২২/৮/২০১৪)। একদা আশ্রমিক শান্তিনিকেতনে। লেখাপড়া। দেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে। স্নেহেও ধন্য। তৃণা গায়িকা। বাদিকা। গবেষক। লেখিকা। অনুবাদিকা।
শান্তিনিকেতন থেকেই পাড়ি দেন জার্মানির বন–এ। ষাটের দশকে। উদ্দেশ্য অধ্যয়ন। দ্রুত শিখে নেন জার্মান ভাষা। ‘দিদি ফরাসি এবং স্প্যানিশ ভাষাও জানতেন’, বলেন বিভূতি বসু, নিজেকে পরিচয় দেন ‘বনবাসী।’ বিভূতি বসুর আরও কথা, ‘দিদি আমার চেয়ে সতেরো বছরের বড়, দিদি আমাকে ‘বনবাসী’ বলে ডাকতেন। তৃণাদিই প্রথম, গোটা পশ্চিম জার্মানিতে টাগোর সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, বন–এ। বাঙালি সদস্য সংখ্যা কম, জার্মানই বেশি। দিদির উদ্দেশ্য ছিল জার্মানদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে ছড়িয়ে দেওয়া। সফলও হয়েছিলেন কিছুটা, তবে ব্যাপক অর্থে নয়। সমস্যাও ছিল বিস্তর। প্রথমত আর্থিক। বন–এর বাইরেও তো জার্মানির বহু শহর অঞ্চল জেলা রাজ্য আছে। প্রচারণার জন্যে সদস্য তথা জনগোষ্ঠী দরকার, ছিল না। না থাকলেও তৃণাদি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অনুবাদ করেছেন বিস্তর, জার্মান ভাষায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুবাদ করে বাংলা ও জার্মান অনুবাদে গেয়েছেন অনেক অনুষ্ঠানে। শ্রোতাও তৈরি করেছিলেন। কেউ–কেউ গানও শিখেছেন দিদির কাছে। যেখানে বাঙালি সেখানেই ঝামেলা, জার্মানদের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন নিয়ে সমালোচনা নয় শুধু, কুকথাও প্রচার করে বঙ্গীয় ‘রবীন্দ্রবোদ্ধারা’। ফলে সোসাইটিতেও চিড় ধরে এক সময়। হতাশ হন তৃণাদি। এও বাহুল্য, দিদির রবীন্দ্রকবিতা–গানের অনুবাদ নিয়ে দু’চারজন বাঙালি পণ্ডিত, যাঁরা জার্মান জানেন, আপত্তি জানান। দিদি অবশ্য চ্যালেঞ্জ করেছেন। করলেও তাঁর পক্ষে কেউ ওকালতি করেননি। দিদি মর্মাহত। মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে গেছেন শান্তিনিকেতনে।’
তৃণা পুরোহিতের রবীন্দ্রসাহিত্য অনুবাদ (জার্মান) এখন আর পাওয়া যায় না, সংস্করণও প্রকাশিত হয়নি, তবে বিভিন্ন পাঠাগারে আছে। তৃণা পুরোহিতকে স্মরণে রেখেই গত বছর বার্লিনে ‘রবীন্দ্রনাথ টাগোর সোসাইটি’ তৈরি হয়েছে। করেছেন বাংলাদেশিরা। তৃণা পুরোহিতের অনুবাদ (এবং আরও অনেকের) সংগ্রহ করা হচ্ছে। রবীন্দ্রজন্মদিনে, পঁচিশে বৈশাখে, রবীন্দ্রনাথ টাগোর সোসাইটির অনুষ্ঠানে তৃণা পুরোহিতের রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদ পাঠ এবং গান অনুবাদ গাওয়া হয়, গেয়েছেন বাঙালি ও জার্মানরাও। মৃত্যুদিনে, বাইশে শ্রাবণেও তৃণা পুরোহিতের অনুবাদপাঠ, অনূদিত গানও গাওয়া হবে।
জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ। বার্লিন শহরতলিতে, আলবার্ট আইনস্টাইনের বাড়িতে। ১৪ জুলাই, ১৯৩০।