অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি দিল্লি এলেন, আনুষ্ঠানিক ডাক পেলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। এক ভারতীয় নোবেলজয়ী, কথা বলতে চাওয়া স্বাভাবিক। চল্লিশ মিনিটের বৈঠক। সৌজন্য। শুরুতেই, অভিজিৎ জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহাস্যে, মিডিয়া আপনার মুখে আমার বিরুদ্ধে কথা শোনার জন্য বসে থাকছে। নোবেলজয়ী বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বললেন, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু টেলিভিশনে স–ব দেখছেন! মজা, বেশ। কিন্তু, মোদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতির কঠোর সমালোচক অভিজিৎ ব্যানার্জিকে মৃদু (সহাস্য!) হুমকির বার্তা দেওয়া হল কি? আমাদের মন ‘কু’ ডাকে, নিতান্তই অকারণে কি?
রেল ও বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বললেন, ‘অভিজিৎ ব্যানার্জি তো বামপন্থী! কংগ্রেসের প্রস্তাবিত ন্যায় প্রকল্পে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে।’ নোবেলজয়ীর জন্য গর্ব প্রকাশের কী ধরন, কী ভাষা! আরএসএস–ঘনিষ্ঠ ‘শিক্ষণ মণ্ডল’–এর নেতা কানিতকার নিবন্ধে লিখলেন, ‘অভিজিৎ ব্যানার্জির চিন্তাভাবনা গোটা পৃথিবীতেই প্রত্যাখ্যাত। একজন এমন ভারতীয়কে নোবেল দেওয়াটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হতে পারে!’ অমর্ত্য সেনের নোবেল জয়েও গেরুয়া নেতারা ফুঁসেছিলেন। দারিদ্র দূরীকরণের পথ–খোঁজা বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ। কিন্তু, সাম্প্রদায়িকতা–বিরোধিতায় অবিচল। বাজপেয়ী তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। আর মোদি সরকার তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদ থেকে চলে যেতে কার্যত বাধ্য করে। অভিজিৎকেও চাপা হেনস্থা করা হচ্ছে এবং তাতে তাঁর জনমুখী ভাবনাই আরও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
রাজ্য বিজেপি দেড় কাঠি ওপরে। অসভ্যতায় নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন। একটু পরে আসছি। অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি বলেন, ‘আমি লেফট অফ দ্য সেন্টার। আমেরিকায় বলা হয়, লেফট ডেমোক্র্যাট। কোনও বিশেষ পন্থায় কট্টর নই।’ একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তাঁর প্রস্তাব, রুগ্ণ ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারি হাতে দেওয়া হোক। ব্যাঙ্কে সরকারের শেয়ার ৫০ শতাংশের মধ্যে রাখা হোক। ৫০ শতাংশ বা বেশি হলেই ব্যাঙ্ক এসে যাচ্ছে সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন–এর আওতার মধ্যে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তো আছেই তদারকির জন্য। সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন কেন? তাতে ব্যাঙ্ক কর্তারা ভয় পাচ্ছেন, ন্যূনতম ঝুঁকি নিচ্ছেন না,
ফলে সমস্যা হচ্ছে ব্যাঙ্ক পরিচালনায়। সুতরাং, ব্যাঙ্কে রাষ্ট্রের শেয়ার ৫০–এর নীচে থাকুক। কোনও বামপন্থী, কোনও মধ্যপন্থী, কেউই অভিজিতের এই
বক্তব্যকে সমর্থন করেন না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সরকারের শেয়ার কমানোর
প্রস্তাবকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষও গ্রহণ করবে না। ‘বামপন্থী’ লেবেল সেঁটে দেওয়া হাস্যকর।
অভিজিৎ ব্যানার্জি নোটবন্দির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এর ফলে অর্থনীতিতে বিপর্যয় অনিবার্য। বলা বাহুল্য, মোদি পছন্দ করেননি। বাজেটে নির্মলা সীতারামন কর্পোরেট কর বাড়ানোয় ‘ভাল’ বলেছিলেন অভিজিৎ। পরে যখন ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হল কর্পোরেট রাঘববোয়ালদের, অভিজিৎ তীব্র সমালোচনা করেন। নোবেল পাওয়ার দিনেও বলেছেন, ‘ভারতের অর্থনীতির হাল খুব খারাপ। গরিবদের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। কৃষকদের দুর্নীতির দিকে তাকানো উচিত।’ বিজেপি–র হজম হচ্ছে না। আগেও বলেছেন, কিন্তু এখন? নোবেলজয়ীর মুখে! কী করে হজম হবে?
যে কথা বলছিলাম, বাংলার বিজেপি নেতারা অসভ্যতায় দেড় কাঠি ওপরে। প্রথম দিনই, দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘উনি তো হাফ বাঙালি!’ যে–দল ভারতীয়তার কথা তিনবেলা প্রচার করে, তাদেরই কটাক্ষ, হাফ বাঙালি, মা তো মারাঠি! রাহুল সিনহা এমনিতে সামান্য কোণঠাসা, এই ইস্যুতে আরও কুকথা বলে সামনে আসতে চাইলেন: ‘দ্বিতীয় স্ত্রী বিদেশি হওয়াটা বোধহয় নোবেল পাওয়ার একটা কোয়ালিফিকেশন!’ চমৎকার বললেন অভিজিতের মা, গুণী শিক্ষাবিদ নির্মলা ব্যানার্জি : ‘বেশ তো, উনিও একজন বিদেশিনীকে বিয়ে করে ফেলুন। এস্থারের মতো গুণী মেয়ে পাবেন না, কিন্তু করুন। আরেকটা নোবেল আসবে বাংলায়। ভাল তো!’ দু–দিন দম নিয়ে দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘আমেরিকার জামাই, সেটা তো সত্যি!’ জানেন না, এস্থার ডাফলো ফরাসি। ফ্রান্সে সংবাদে হেডিং, ‘এস্থার ডাফলো, তাঁর স্বামী এবং আরেকজন অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন।’ ফরাসি গর্ব। দিলীপ ঘোষরা বাঙালি? ভারতীয়? এবং, জানেন না, এস্থার প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ, গবেষণায় অভিজিতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সমান–সমান।
আর, বিজেপি প্রভাবিত সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষ ঝরে পড়ল বাঙালি নোবেলজয়ীর নীতি–ভাবনা নিয়ে। ভিত্তিহীন কুৎসা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।
পাশাপাশি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দেখুন। মা নির্মলা ব্যানার্জির কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। তাঁর ও ছেলের জন্য উপহার নিয়ে গেলেন। প্রায় চল্লিশ মিনিট নিখাদ ভালবাসায় ভরিয়ে দিলেন নোবেলজয়ীর মা–কে। নির্মলা অভিভূত, বললেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী সৎ, পরিশ্রমী, গ্রেট লেডি।’ যিনি প্রায় পাঁচ দশক বাংলায়, শিক্ষাবিদ, বাংলা বলেন আমাদের চেয়ে ভাল, তাঁর বাঙালি পরিচয় নিয়ে কটাক্ষ করে বিজেপি। আর মমতা বলেন, ‘মায়ের কোনও জাত হয় না।’
মমতা–নির্মলার ছবিটা বাঙালির মনে গেঁথে গেল। যারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙে, তারা ‘বাঙালি’? যে–দলের রাজ্য সভাপতি যাদবপুরের প্রতিবাদী ছাত্রীদের কুরুচিকর ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন তারা ‘বাঙালি’? এস্থার ডাফলো সম্পর্কে উত্তরবঙ্গে মমতা বললেন, আমাদের একসঙ্গে দুটো নোবেল। ডবল ডবল।
বাঙালি দেখলেন পাশাপাশি দুটি ছবি। শুনলেন দু–রকম কথা। দেখলেন–শুনলেন মমতার শ্রদ্ধা, ভালবাসা। বুঝলেন, তিনি বাঙালি তো বটেই, ভারতীয়, বিশ্বনাগরিক। উদার বাঙালি। কাদের বেছে নেবেন বাঙালি? কোনও সন্দেহ থাকছে না। অসভ্যতার ফল পাবেন অসভ্য বিজেপি নেতারা। মমতাকে সরাতে চান? ফুঃ।