পল্লব বসুমল্লিক
বিশপ লেফ্রয় রোডের শিখর–উচ্চ মানুষটি ১৯৭৬ সালে আকাশবাণীর জন্য এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে আমায় বলেছিলেন, ভাল ফিল্ম মানে অ্যা ভেরি গুড টেক অফ অ্যান্ড ইকুয়ালি ব্রিলিয়ান্ট ল্যান্ডিং। সিল্কিস্মুদ ফ্লাইট অল দ্য ওয়ে। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা সম্পর্কে অব্যর্থ মূল্যায়ন সাহিত্যেও প্রযোজ্য। বারপুজো রেশম–মসৃণ এক উড়ানই। প্রথম উপন্যাস উইকি সুপারহিট, গৌতম নিশ্চিত থাকতে পারে এটা হতে চলেছে সুপারডুপার ব্লকবাস্টার। বুম্বা (প্রসেনজিৎ) থেকে পুলুদা (সৌমিত্র), শাহরুখ থেকে বিগ বি— অনায়াস ফিল্মি ঘাঁটাঘাঁটি তাকে শিখিয়েছে কীভাবে নাটকীয় উপাদান গেঁথে দিতে হয়। ফুটবল কোচ অর্চিত মুখার্জি কেন্দ্রীয় চরিত্র। যাঁর ডিএনএ–তে এমবেডেড একটাই থিম— জীবনে প্যাশনের সঙ্গ ছাড়তে নেই। প্রতিটা মোড়ে নতুন মোচড়। প্লট সাজানো ময়দানের গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস ও ঘটনা দিয়ে। গট আপ কিংপিনরা উপস্থিত, রয়েছেন ময়দানি মাফিয়ারা, সর্বোপরি ভয়ঙ্কর হোমো স্যাপিয়েন্স— বাংলার ক্লাব কর্মকর্তা! এমন স্পিসিস ভূ–ভারতে কেন, দুনিয়ায় মেলা ভার। লেখক জানিয়েছে উপন্যাস লেখার সময়সীমা নাকি মাত্র দেড় মাস। নিশ্চিত থাকতে পারেন, এটা ডাহা মিথ্যে। থিম সাজানো, ব্যাক আপ রিসার্চ এবং ‘গেটিং থটস টুগেদার’— অন্তত বছর তিনেকের নিরলস ফোকাস। ভাল জাতের বিরিয়ানি কি মাত্র আধ ঘণ্টায় তৈরি হয়?
স্পোর্টস কোচের জীবন, তাঁর সংগ্রাম এবং ঘাত–প্রতিঘাত নিয়ে সাহিত্য এবং সিনেমায় বেশ কিছু কালজয়ী কাজ হয়েছে। বিজাতীয়, তবু বেসবল কোচ বিলি বিয়েনের অসামান্য জীবন নিয়ে লেখা ‘মানিবল: দ্য আর্ট অব উইনিং অ্যান আনফেয়ার গেম’। টপ ক্লাস। ‘জেন মাস্টার’ অর্থাৎ বাস্কেটবল কোচ ফিল জ্যাকসনের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘ইলেভেন রিংস’ অলটাইম বেস্টসেলার তালিকায় স্থান পেয়েছে। মাইকেল জর্ডান, ডেনিস রডম্যান বা অকালপ্রয়াত কোবে ব্রায়ান্টের এই প্রশিক্ষক কখনও ঘ্যানঘ্যানে নাগিং করতেন না। তাঁর অনুপ্রেরণার পদ্ধতি ছিল ‘আউট অব দি বক্স’। ১৯৮০ শীতকালীন অলিম্পিক জেতা মার্কিনি আইস হকি দলকে অসাধ্যসাধন করান হার্ব ব্রুকস নামে মধ্যমেধার এক কোচ। ২০০৪ সালে মুক্তি পায় সেই অলিম্পিকের ভিত্তিতে ‘মিরাকল’। সিনেমায় কার্ট রাসেলের অভিনয় কে ভুলবে? অনেক বেশি একাত্ম লাগবে, ‘চক দে ইন্ডিয়া’য় হকি কোচ কবীর খানের ভূমিকায় শাহরুখ খান অনবদ্য। এমনকী ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ‘লড়াই’–তে ফুটবল মাঠে হেরে যাওয়া কোহলবিধ্বস্ত ফুটবলার সেবাস্টিয়ান রায়ানের জঙ্গলমহলের অজ্ঞাতকুলশীল ছেলেদের দিয়ে জয়ের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ একটা ফুটবল দল তৈরির গল্পটাও অসামান্য।
দুই খ্যাতনামা সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং অশোক দাশগুপ্ত বলেছেন, মতি নন্দীর প্রতিটা শব্দে পাই ‘স্ট্রাকচারড্ লেবার’, পরিশ্রম, ঘামের চিহ্ন। গৌতম কিন্তু বরাবর সাবলীল নদী। ফ্রি ফ্লোয়িং। জে কে রাউলিং ২০১৯–এর টপ সেলার, তাঁর বই বিক্রির পরিমাণ ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কেন? গল্প বলার ধরন, অনৈসর্গিক সব ট্যুইস্টে। প্রায় সেই স্টাইল বাংলা ক্রীড়াসাহিত্যে আমদানি হল। বাংলা এবং সার্বিকভাবে ভারতীয় ফুটবলের অন্তর্জলি যাত্রায় ‘বারপুজো’ স্রোত উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার দিকচিহ্ন হয়েই থাকবে। ফুটবলের একনিষ্ঠ ছাত্র ও ফুটবল মেডিসিন গবেষক হিসেবে জানি ২–৬–২ ছক ভারতীয়দের পক্ষে এ মুহূর্তে রূপায়ণ প্রায় দুঃসাধ্য। তবু অর্চিতের এই ছকভাঙা ফর্মেশন নিয়ে ফিফা–তেও তোলপাড়। ক্যাপটিভ অডিয়ান্সকে রুদ্ধশ্বাস ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছনো গৌতমের কাজ। বার্তা স্পষ্ট— ‘টেক ইট অর রিজেক্ট ইট’। ফুটবল এবং বাংলাসাহিত্য ভালবাসলে আপনাকে ‘বারপুজো’ বুকে ঠাঁই দিতেই হবে। ■
বারপুজো • গৌতম ভট্টাচার্য • দীপ প্রকাশন • ৩০০ টাকা